মানবদেহের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ ফুসফুস। ফুসফুস কিভাবে কাজ করে, এটা জানলে মানবদেহের অনেক কিছুই বোঝা সম্ভব হবে। শ্বসনতন্ত্রের প্রধান অঙ্গ হচ্ছে ফুসফুস যার মাধ্যমে শ্বাসকার্য সম্পন্ন হয়ে থাকে।
শ্বসনতন্ত্রের সাথে অন্যান্য অঙ্গসমূহ হচ্ছে শ্বাসনালী। যার সাহায্যে ফুসফুসে বাতাস প্রবেশ করে থাকে ও বের হয়। ফুসফসের চারপাশে থাকে রক্তনালী। এছাড়াও থাকে পেশীসমূহ যা শ্বসনে সাহায্য করে থাকে।
ফুসফুস আমাদের দেহে বিশুদ্ধ বাতাস প্রবেশ করতে সাহায্য করে থাকে। এছাড়াও, দেহ থেকে ক্ষতিকারক কার্বন ডাই অক্সাইড ও অন্যান্য অপ্রয়োজনীয় গ্যাস বের হতে সাহায্য করে। তো এই কাজগুলো বোঝার জন্য জানতে হবে, ফুসফুস কিভাবে কাজ করে? আজকের লেখায় আমরা এই সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
ফুসফুস কিভাবে কাজ করে?
শ্বাসগ্রহণের কাজে আমরা আমাদের পেশী ব্যবহার করে থাকি। বিশেষ করে প্রধান পেশী বা ডায়াফ্রাম। এই ডায়াফ্রাম আমাদের শরীরকে সংকুচিত ও চ্যাপ্টা করে দেহের ভেতরে বাতাস প্রবেশ নিশ্চিত করে থাকে। আবার যখন নি:শ্বাস বের করার দরকার হয় তখন ডায়াফ্রাম শিথিল হয়ে যায়। এর ফলে ফুসফুস থেকে বাতাস বের হয়ে যায়।
শরীরে অক্সিজেন পাওয়ার জন্য আমাদের মুখ ও নাক দিয়ে বাতাস প্রবেশ করাতে হয়। মুখ ও নাকের মিউকাস মেমব্রেন এই বাতাসকে উষ্ণ ও আর্দ্র করে থাকে এবং এতে থাকে দূষিত বস্তু যেমন ধুলা ও ময়লা ইত্যাদি প্রবেশে বাধা দান করে।
এই বাতাস গলায় এসে শ্বাসনালী বা ট্রাকিয়াতে প্রবেশ করে। ট্রাকিয়া বাম ও ডান ব্রঙ্কাইয়ে বিভক্ত। এই ব্রঙ্কাসগুলো আবার বিভিন্ন শাখা প্রশাখায় বিভক্ত। এগুলো ক্রমান্বয়ে সরু থেকে সরুতর হতে থাকে।
শ্বাসনালী গিয়ে অ্যালভিওলাইতে শেষ হয়। এগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বায়ুথলির মতো দেখতে। যখন আমরা শ্বাস নেই তখন বক্ষপিঞ্জর প্রস্তত হয় এবং এই বায়ুথলিগুলো বাতাস প্রবেশ করে ফুলে উঠে। আবার যখন নি:শ্বাস ত্যাগ করি তখন এখান থেকে বাতাস বের হয়ে যায়।
এই অ্যালভিওলাইগুলো অসংখ্যা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রক্তনালিকা দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকে। অক্সিজেন বায়ুথলির এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে চলাচল করে এবং রক্ত দ্বারা বাহিত হয়ে সমগ্র শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। কার্বন ডাই অক্সাইড ও অন্যান্য গ্যাস সমূহ আলাদা হয়ে নি:শ্বাসের সাথে বের হয়ে যায়।
ফুসফুস অক্সিজেন ও কার্বন ডাই অক্সাইড চলাচল করা ছাড়াও আরো কাজ করে থাকে। এটি দেহের ছাঁকনি হিসেবে কাজ করে থাকে। এর মিউকাস বিভিন্ন ধুলোবালি, জীবানু ও অন্যান্য বস্তু যা ফুসফুসে প্রবেশ করতে চায় সেটিকে প্রবেশে বাধা দেয়।
শ্বসনতন্ত্রের অঙ্গসমূহ এবং তাদের কাজ

১. শ্বাসযন্ত্র
সাইনাস: এটি হলো একটি ফাঁকা স্থান যেটি চোখের নিচে থাকে এবং নাকের সাথে সংযুক্ত হয়ে একটি ক্ষুদ্র ছিদ্রের মাধ্যমে উন্মুক্ত হয়। সাইনাস নাকে প্রবেশকৃত বাতাসকে প্রয়োজনীয় তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা দিয়ে থাকে।
নাক: নাক হচ্ছে বাতাস প্রবেশ ও প্রস্থানের একটি উত্তম পথ। নাকের ভিতর যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র লোম থাকে এগুলো নাকে প্রবেশকৃত বাতাসকে পরিষ্কার করে থাকে।
মুখ: মুখ দ্বারা ও ফুসফুসে বাতাস প্রবেশ করে থাকে। অনেক সময় ঠান্ডার কারণে যখন নাক বন্ধ হয়ে যায় তখন মানুষ মুখ দ্বারা শ্বাসকাজ সম্পন্ন করে থাকে।
গলা: নাক ও মুখ দ্বার প্রবেশকৃত বাতাস গলা দিয়ে ট্রাকিয়াতে প্রবেশ করে থাকে।
ট্রাকিয়া বা শ্বাসনালী: গলা থেকে ফুসফুস পর্যন্ত যে লম্বা নালী বিস্তৃত থাকে সেটিই ট্রাকিয়া।
ব্রঙ্কিয়াল নালী: শ্বাসনালী দুইটি প্রধান নালীতে বিভক্ত যা ব্রঙ্কিয়াল নালী নামে পরিচিত।
২. পেশীসমূহ
শ্বাসগ্রহণের সময় ফুসফুসকে প্রসারিত বা বায়ুপূর্ণ করার জন্য কিছু পেশীর ভূমিকা রয়েছে।
৩. ডায়াফ্রাম
এটি ফুসফুসের নিচে অবস্থিত। শ্বাস প্রশ্বাসে সাহায্য করার জন্য এটি প্রধান ভূমিকা পালন করে থাকে। এটি বক্ষ পিঞ্জর ও পাকস্থলী কে আলাদা করে রেখেছে এবং ফুসফুসকে বায়ু দ্বারা ফুলে থাকতে সাহায্য করে।
৪. ইন্টারকোস্টাল পেশী
এটি পাঁজরের নিচে অবস্থিত। বক্ষ গহ্বরের মধ্যে ফুসফুসকে প্রসারিত হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় জায়গা সরবরাহ করে থাকে এই পেশী।
৫. অ্যাবডোমিনাল পেশী
ফুসফুস যখন বাতাস দ্বার প্রসারিত হয় তখন পাকস্থলী গহ্বরে পাকস্থলীর পেশি সমূহকে সংকুচিত করে ফুসফুসকে প্রসারিত হওয়ার জন্য জায়গা প্রদান করে থাকে এই পেশী।
৬. ঘাড় এবং উর্ধ্ব বক্ষের পেশী
ফুসফুস যখন কোন রোগ দ্বারা আক্রান্ত হবার কারণে অন্যান্য পেশী সমূহ ঠিকমত কাজ করে না এবং যখন নি:শ্বাস গ্রহণ ও ত্যাগ করা কঠিন হয়ে পড়ে তখন এই পেশী সাহায্য করে থাকে।
ফুসফুসে কিভাবে বিশুদ্ধ বাতাস প্রবেশ করে?
আমরা আগেই দেখেছি যে নাকের ভিতর থাকা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র লোম দ্বারা বাতাস বিশুদ্ধ হয়ে থাকে এবং তারপর সেই বাতাস ভিতরে প্রবেশ করে। বেশিরভাগ বড় বড় ধুলোকণা নাকের বাইরেই থেকে যায় কারণ এগুলো বাতাসের সাথে ভিতরে প্রবেশ করার চেষ্টা করলে হাঁচির উদ্রেক হয় যার ফলে সে ভিতরে যেতে পারেনা।
কিন্তু যদি কোনভাবে কোন ক্ষুদ্র কণা ভেতরে প্রবেশ করেই ফেলে তখন ব্রঙ্কাই ও ব্রঙ্কিওল মিউকাস ক্ষরণ করে থাকে সেই বস্তুকে ধরার জন্য। এখানে বায়ুথলির গায়ে থাকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চুলের ন্যায় বস্তু যাকে বলে সিলিয়া। এর সেই মিউকাসকে উপর দিকে গলার দিকে ঠেলে দেয় যা থুথু বা কফ হয়ে বের হয়ে আসে।
নাক এবং শ্বাসনালী দ্বারা বিশুদ্ধ বাতাস বায়ুথলিতে প্রবেশ করে। এই বায়ুথলি দ্বারাই সমগ্র দেহে অক্সিজেন পরিবহন হয়ে থাকে। এছাড়াও কোন ভাবে যদি ধুলোবালি বায়ুথলিতে প্রবেশ করে ফেলে তখন সেখানে তাদের বাধা দেয় ম্যাক্রোফ্যাজ।
দূষিত বাতাস প্রবেশের সমস্যা
বিভিন্ন ভাবে বিভিন্ন বস্তু আমাদের শ্বাসের সাথে প্রবেশ করতে পারে। এইসব বস্তু প্রবেশে আমাদের নানা রকম সমস্যা হতে পারে। যেমন
- ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া প্রবেশের ফলে ইনফেকশন হতে পারে যেমন ঠান্ডার সমস্যা বা নিউমোনিয়া
- ধুলোকণা প্রবেশ করলে এলার্জি হতে পারে।
- বায়ু দূষন বা বিভিন্ন ধোঁয়া বা সিগারেটের ধোঁয়া ক্ষতি করতে পারে বা শ্বাসকষ্টের কারণ হতে পারে।
- সিগারেটের ধোঁয়া ফুসফুসের ক্যান্সারের কারণ হতে পারে।
ফুসফুস আমাদের দেহের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ। যার ফলে আমাদের দেহ বিশুদ্ধ বাতাস পেয়ে থাকে। তাই আমাদের এটিকে খুব যত্ন করতে হবে। ফুসফুসের যে কোন প্রদাহে দ্রুত ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে। সিগারেট ত্যাগ করতে হবে। যেকোন ধরনের বায়ু দূষণ জনিত স্থান পরিত্যাগ করতে হবে।
উপসংহার
এই ছিল আজকে ফুসফুস কিভাবে কাজ করে? এই নিয়ে সংক্ষিপ্ত লেখা। আশা করি আমাদের এই ছোট লেখার মাধ্যমে ফুসফুস কিভাবে কাজ করে এই সম্পর্কে কিছুটা হলেও ধারণা হয়েছে। পড়তে পারেন, এয়ার কন্ডিশনার কিভাবে কাজ করে?