ইন্টারনেট আমাদের বর্তমান জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কম্পিউটার, স্মার্টফোন, টিভি এমনকি ঘরের আসবাপত্রের জন্যেও এখন ইন্টারনেট প্রয়োজন হয়। আর সেই ইন্টারনেট যদি স্লো থাকে, তাহলে তো পুরো জীবনই স্লো হয়ে যায়। আর এই ইন্টারনেট আসলে স্লো কিনা সেটা বোঝার জন্য প্রয়োজন হয়, ইন্টারনেট স্পিড টেস্ট করার।
নিয়মিত ইন্টারনেট গতি পরীক্ষা করার মাধ্যমে আপনি আপনার সংযোগের কর্মক্ষমতা এবং আপনার সংযোগের ডাউনলোড এবং আপলোড গতি ভালভাবে বুঝতে পারবেন। আজকের এই লেখার মাধ্যমে এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করা হবে।
নেট স্পিড টেস্ট করার ক্ষেত্রে কেমন নেট স্পিড ভাল?
ফেডারেল কমিউনিকেশন কমিশন (এফসিসি) অনুসারে, ভাল ইন্টারনেট স্পীড হল দৈনন্দিন অনলাইন কাজ সম্পাদন করার জন্য ডাউনলোডের সর্বনিম্ন গতি 25 এমবিপিএস থাকা সাধারণ কাজ-কর্মের জন্য আপনার কতটুকু নেট স্পিড প্রয়োজন সে সম্পর্কে অবশ্যই আপনাকে জানতে হবে। আপনি কি ধরণের কাজ করবেন, সেটা নিচের তালিকা দেখলেই বুঝবেন। যেমন:
- ইমেল এবং ওয়েব ব্রাউজিং এর জন্য ১-৫ এমবিপিএস।
- এইচডি ভিডিও স্ট্রিমিংয়ের জন্য ১৫-২৫ এমবিপিএস।
- লাইভ স্ট্রিমিং 4k ভিডিও এবং হালকা অনলাইন গেমিং জন্য ৪০-১০০ এমবিপিএস।
- 4k ভিডিও স্ট্রিমিং, অনলাইন গেমিং এবং বড় ফাইল ডাউনলোড করার জন্য 200+ এমবিপিএস থাকলে ভাল।
বলে রাখা ভাল, আপনি স্পিড টেস্ট করার সময় দেখবেন স্পিড দেখাচ্ছে 5mbps কিন্তু ডাউনলোড করলে পাচ্ছেন 640kbps। এর কারণ হলো, আপনার এই 5mbps লাইনটি ৮ জনকে ভাগ করে দেয়া হয়। তাই স্পিডের ক্ষেত্রে 640kbps পান।
ইন্টারনেট স্পিড টেস্ট করার ওয়েবসাইট
১. fiber.google.com
এটা গুগলের ইন্টারনেট স্পিড টেস্ট করার ওয়েবসাইট। এটা দিয়ে আপনি নেট স্পিড টেস্ট করার জন্য আপনি পছন্দ মত বিভিন্ন দেশের সার্ভার সিলেক্ট করতে পারবেন। কিভাবে কি করবেন সেটা স্ক্রিনশট সহ বুঝিয়ে দিচ্ছি। প্রথমে ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন। তারপর নিচের মত পেজ আসবে।
এবার লাল মার্ক করা জায়গায় ক্লিক করে আপনার থেকে সবচেয়ে দূরের দেশ সিলেক্ট করুন। নিচের ইমেজ দেখলেই বুঝবেন, আমি আমেরিকার নিউ ওয়ার্ক সিলেক্ট করেছি। মনে রাখবেন বাংলাদেশের কোন কিছু নির্বাচন করলে আপনাকে BDIX এর স্পিড দেখাবে। যেটা আসলে রিয়াল স্পিড বলা যায় না। মূলত দূরের দেশগুলো থেকে যে স্পিড পান সেটাই আসল স্পিড।
সার্ভার সিলেক্ট করে, Go তে ক্লিক করুন।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন। তারপর দেখতে পারবেন। আপনার ইন্টারনেট স্পিড, পিং, জিটার, ডাউনলোড এবং আপলোড স্পিড দেখাচ্ছে।
২. speed.cloudflare.com
এটাও বেশ জনপ্রিয় ইন্টারনেট স্পিড টেস্ট ওয়েবসাইট। CDN প্রোভাইডার ক্লাউড ফ্লেয়ারের একটি নেট স্পিড টেস্ট সাইট। এটা দিয়েও আপনি Jitter, Ping, Download, Upload স্পিড দেখতে পারবেন।
৩. speedof.me
নেট স্পিড টেস্ট করার পাশাপাশি আপনি আপনার আইপি, LATENCY চেক করতে পারবেন। এছাড়া, আপনার স্পিড কত পান সেটা চেক করে; সেই রিপোর্ট অন্য মানুষের সাথে লিংকের মাধ্যমে শেয়ার করতে পারবেন।
৪. speedsmart.net
স্পিড টেস্ট করার নরমাল ফিচারগুলো এর মধ্যে পাবেন। পাশাপাশি সার্ভার চেঞ্জ করার সুবিধা আছে এতে।
৫. fast.com
এটাতে যে স্পিড দেখাবে। এটাই আপনার নেটফ্লিক্সের স্পিড।
৬. speedtest.net
এটা বেশ জনপ্রিয় ইন্টারনেট স্পিড টেস্ট করার ওয়েবসাইট। এটাকে লিস্টের শেষে রাখলেও, বহুল ব্যবহৃত স্পিড টেস্ট করার ওয়েবসাইট এটি।
ইন্টারনেট স্পিড টেস্ট করার অ্যাপ
অ্যান্ড্রয়েড ফোনের জন্য | আইফোনের জন্য |
---|---|
Ookla | Ookla |
Meteor | Meteor |
SpeedTest Master | SpeedTest Master |
SpeedSmart Speed Test | SpeedSmart Speed Test |
V-SPEED | V-SPEED |
FAST | FAST |
FCC Speed Test | FCC Speed Test |
কিভাবে ইন্টারনেট স্পীড টেস্ট বুঝতে হয়?
ইন্টারনেটের গতি পরীক্ষা করার মাধ্যমে আপনি আপনার বর্তমান ব্রডব্যান্ডের স্পিড যাচাই করতে পারবেন। স্পিড পরীক্ষা করার মাধ্যমে একটি সার্ভার থেকে ফাইল প্রেরণ এবং আপনার স্থানীয় ডিভাইসে ফাইল ডাউনলোড করতে কত সময় লাগে তা বিশ্লেষণ করা যায়। একবার টেস্ট সম্পূর্ণ হয়ে গেলে, আপনি সম্ভবত নিম্নলিখিত বিষয়গুলি নিয়ে সংশয় হতে পারে। তাই, প্রশ্ন সহ উত্তর দেয়ার চেষ্টা করেছি।
ডাউনলোড স্পীড কি?
স্পীড পরীক্ষার সার্ভার থেকে তথ্য আপনার কম্পিউটার বা স্মার্টফোনে সেভ করতে আপনার ইন্টারনেট সংযোগের যে পরিমাণ সময় লাগে সেটিই মূলত ডাউনলোড স্পীড। ডাউনলোড স্পীড সাধারণত আপলোড স্পীডের চেয়ে অনেক বেশি হয়ে থাকে। ডাউনলোড স্পীড প্রতি সেকেন্ডে মেগাবাইটে (এমবিপিএস) পরিমাপ করা হয়।
আপলোড স্পীড কি?
আপলোড স্পীড হল আপনার সংযোগের জন্য স্পিড পরীক্ষা করতে যে সার্ভার ইউজ করা হয়, সে সার্ভারে তথ্য ফেরত পাঠাতে যে সময় লাগে তার হিসাব। ইমেল পাঠানো, ভিডিও চ্যাট করা এবং সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে ছবি পোস্ট করার মতো সাধারণ অনলাইন কাজগুলি করার জন্য যথার্থ আপলোড স্পীড প্রয়োজন। আপলোড স্পীড প্রতি সেকেন্ডে মেগাবাইট দ্বারা পরিমাপ করা হয়।
পিং কি?
পিং আপনার সংযোগের প্রতিক্রিয়া মানে রিএক্টের সময় পরিমাপ করে, আর রেকর্ড করে যে আপনি কোন একটা ওয়েবসাইটে ক্লিক করার পর কত দ্রুত রিএকশন পাচ্ছেন (ওয়েবসাইট লোড হচ্ছে)। আপনার পিং পরিমাপ যত কম হবে, আপনার সংযোগ তত বেশি ফাস্ট হবে। পিং মিলিসেকেন্ডে (এমএস) পরিমাপ করা হয়।
ল্যাটেন্সি কি?
ইন্টারনেট গতি পরীক্ষার জন্য অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হ’ল ল্যাটেন্সি, বা ল্যাগ। ল্যাটেন্সি ব্যান্ডউইথ থেকে আলাদা, যদিও উভয়ই আপনার সংযোগের গতি নিয়ে কাজ করে। ল্যাটেন্সি বলতে আপনার কম্পিউটার থেকে আপনার সার্ভিস সরবরাহকারীর কাছে সংকেত পাঠাতে এবং ফিরে আসতে যে সময় লাগে তাকে বুঝায়।
ব্যান্ডউইথ কি?
ব্যান্ডউইথ হল সর্বাধিক পরিমাণ ডেটা যা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আপনার ইন্টারনেট সংযোগের মাধ্যমে প্রেরণ করা যেতে পারে। আপনি চাইলেই 1GBPS স্পিডে কোন কিছু ডাউনলোড করতে পারবেন না। আপনার আইএসপি যতটুকু দিবে ঠিক তত টুকু স্পিড পাবেন। ব্যান্ডউইথ প্রতি সেকেন্ডে মেগাবাইটে প্রকাশ করা হয়।
এমবিপিএস মানে কি?
ইন্টারনেটের গতি প্রতি সেকেন্ডে বাইট (একটি একক বাইনারি 1 বা 0) দ্বারা পরিমাপ করা হয়। ইন্টারনেট সংযোগ এই ডেটা দিয়ে পরিচালনা করা হয়, তাই আমরা সাধারণত প্রতি সেকেন্ড গতি মেগাবাইট দ্বারা পরিমাপ করে থাকি (এমবিপিএস), যার মানে প্রতি সেকেন্ডে এক মিলিয়ন বাইট।
যখন গতি সত্যিই দ্রুত হয় (১,০০০ এমবিপিএস বা দ্রুত), আমরা প্রতি সেকেন্ড গিগাবাইট (জিবিপিএস) ধরে থাকি, যা প্রতি সেকেন্ডে এক বিলিয়ন বাইট। (১,০০০ এমবিপিএস = ১ জিবিপিএস)
কিসের উপর ইন্টারনেট স্পিড নির্ভর করে?
ইন্টারনেট স্পীড সম্পর্কে সবাই যে জিনিসটা জানে, তা হল সব ইন্টারনেট সংযোগ সমান স্পিড পাওয়া যায় না। বেশিরভাগ ISP বিভিন্ন টাইপের লাইন দিয়ে থাকে। যেমন:
ডায়াল-আপ ইন্টারনেট: এটা হল ধীরগতির ইন্টারনেট সংযোগ যা আসলে স্ট্রিমিং ভিডিওর মতো কাজগুলোতে ব্যবহারের জন্য খুবই একটা সুবিধার না।
স্যাটেলাইট ইন্টারনেট: আপনার বাড়ির সাথে ওয়্যারলেস ভাবে সংযুক্ত করতে একটি স্যাটেলাইট সংকেত ব্যবহার করে। স্যাটেলাইট আপনাকে স্ট্রিম ভিডিওর মতো কাজ করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্রডব্যান্ড গতি দিতে পারে। তবে এটি তুলনামূলক-ভাবে ব্যয়বহুল। আপনি এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত জায়গার যেকোন প্রত্যন্ত অঞ্চলে পেয়ে যাবেন। তবে বাংলাদেশে নেই।
ডিএসএল বা ডিজিটাল সাবস্ক্রাইবার লাইন: টেলিফোন নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে, তবে এটি ডায়াল-আপের চেয়ে অনেক বেশি গতিশীল হয়। এটি স্যাটেলাইটের চেয়ে খুব ফাস্ট নয়। আর এর গতি আপনার ISP এর কেন্দ্রীয় অফিসের দূরত্ব দ্বারা প্রভাবিত হয়।
কেবল ইন্টারনেট: কেবল টিভির মতো তামার তার ব্যবহার করে। কেবল অবিশ্বাস্যভাবে দ্রুত গতির হয়ে থাকে, যার গতি ২৫ এমবিপিএস এবং ১০০০ এমবিপিএস (১ জিবিপিএস) এর মধ্যে হয়ে থাকে। তবে এটির একটি অসুবিধা ও রয়েছে। এর মধ্যে বেশি মানুষ সংযুক্ত থাকলে তা ব্যস্ত সময়ে জ্যাম হয়ে যায়। তবে কেবল আপলোড গতির চেয়ে অনেক বেশি ডাউনলোড গতি সরবরাহ করে থাকে।
ফাইবার ইন্টারনেট: ফাইবার অপটিক কেবলের মাধ্যমে আপনাকে ওয়েবের সাথে সংযুক্ত করে। ফাইবার দ্রুততম এবং সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ইন্টারনেট সার্ভিস, যার গতি ৫০ এমবিপিএস থেকে ২,০০০ এমবিপিএস (২ জিবিপিএস) পর্যন্ত হয়ে থাকে। অপটিক্যাল ফাইবার কিভাবে কাজ করে? লেখাটি পড়লেই বুঝবেন।
আপনার কি ধরনের ইন্টারনেট সংযোগ আছে তা বোঝার মাধ্যমে, প্রথমে আপনার সংযোগ কত ফাস্ট হওয়া উচিত সে সম্পর্কে আপনার জানতে হবে। কিন্তু প্রশ্ন হল, এতকিছু জানার পর আপনি আসলে আপনার কতটা গতিশীল সংযোগ পাচ্ছেন। এখন কিছু টিপস দেওয়া হল।
স্পিড টেস্ট করার সঠিক উপায়
WiFi কি? WiFi কিভাবে কাজ করে এই লেখাটি আগে পড়ে নিন। গতি পরীক্ষা করা সহজ তবে এখানে কয়েকটি টিপস দেওয়া হল যার মাধ্যমে আপনি সঠিকভাবে গতি পরীক্ষা করে তার ফলাফল পেতে পারেন:
ডাউনলোড বন্ধ করুন
প্রথমত, নিশ্চিত করুন যে আপনি ব্যাকগ্রাউন্ডে কোনও বড় ফাইল ডাউনলোড করছেন না। আপনি উইন্ডোজের টাস্ক ম্যানেজার অথবা ম্যাকওএস-এ অ্যাক্টিভিটি মনিটর পরীক্ষা করে দেখতে পারেন যে কোনও প্রোগ্রাম আপডেট বা অন্যান্য বড় ফাইল ডাউনলোড করা হচ্ছে কিনা। আপনার কম্পিউটারের সমস্ত অ্যাপ বন্ধ করুন বা leave নিয়ে নিন।
ফ্রিলোডার থেকে মুক্তি পাওয়া
এরপর, নিশ্চিত করুন যে আপনার হোম নেটওয়ার্কে অন্য কেউ আপনার ব্যান্ডউইথের কোন অংশ ব্যবহার করছে কি না। পরীক্ষা করার সময়ে যদি আপনার বাড়ির ভিন্ন কক্ষে নেটফ্লিক্স স্ট্রিমিং করা লোকেরা থাকে তাহলে আপনি সঠিকভাবে পরিমাপ করতে পারবেন না। মানে পরীক্ষা করার সময় সকল ইউজ বন্ধ করে পরিমাপ করতে হবে। আপনার যদি এমন সন্দেহ হয়ে থাকে যে আপনার নেটওয়ার্কে কেউ আপনার ওয়াই-ফাই বা অন্য কোনও ফ্রিলোডার চুরি করতে পারে তাহলে আপনি আপনার নেটওয়ার্ক পাসওয়ার্ডও পরিবর্তন করতে পারেন।
ওয়্যারলেস রাউটারের সমস্যাগুলি পরীক্ষা করা
আপনাকে আপনার রাউটারের অবস্থা সম্পর্কে অবগত হতে হবে এবং সে গুলো নির্মূলের জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে।
এই কয়েকটা বিষয় চেক করে তারপর স্পিড টেস্ট করলে সঠিক রেজাল্ট পাবেন বলে আশা করছি।
পরিশেষে
এই লিখার মাধ্যমে এই পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে যে আপনি সেখানেই আপনার ইন্টারনেট গতি পরীক্ষা করুন যেখানে আপনি প্রায়শই আপনার কম্পিউটার ব্যবহার করেন, এতে আপনি সঠিক পরিমাপ জানতে পারবেন এবং ভাল গতির ইন্টারনেট পাওয়ার বিষয়টি ও নিশ্চিত করতে পারবেন। অপটিক্যাল ফাইবার কিভাবে কাজ করে?