আমরা আমাদের বাড়ির আশেপাশে বা বারান্দায় বিভিন্ন ধরনের গাছ লাগিয়ে রাখি। আর মানুষ বিশেষ করে ঔষধি গাছগুলো লাগাতে বেশি পছন্দ করে। এতে যেমন সৌন্দর্যের সৃষ্টি হয়, তেমন প্রয়োজনের সময় কাজেও লাগানো যায়। এদের মধ্যে নিম গাছ, ঘৃতকুমারী, তুলসী গাছ, পুদিনা গাছ উল্লেখযোগ্য। মজার বিষয় হলো, আজ আমাদের আলোচনা নিম পাতার উপকারিতা নিয়ে।
নিম গাছ এমন এক ধরনের গাছ যে গাছের কাঠ, পাতা, ডাল এমনকি সবকিছুই কাজে লাগানো যায়। আমরা আশেপাশে আমাদের বাসাবাড়িতে অনেককেই নিম গাছ লাগিয়ে রাখতে দেখি। এতে সুন্দর বাতাস পাওয়া যায়। নিম গাছের হাওয়া অত্যন্ত স্বাস্থ্যকর। এছাড়া নিম গাছের ডাল, পাতা সকল কিছুই কাজে লাগানো যায়। কখনো কোন ধরনের পোকা বসেনা এই গাছে।
এই গাছে কখনো উঁইপোকা ধরেনা কিংবা ঘুনে ধরে না। এই কারণে নিম গাছের কাঠ দিয়ে তৈরি আসবাবপত্র দীর্ঘস্থায়ী এবং টেকসই হয়। কেননা, তা সহজে নষ্ট হয় না। ত্বকের যত্নে, চুলের যত্নে, স্বাস্থ্যের জন্য সকল ক্ষেত্রেই নিমগাছের পাতা প্রচুর উপকারী। হাজার হাজার বছর ধরে আয়ুর্বেদিক ক্ষেত্রে এই নিম পাতা ব্যবহৃত হচ্ছে। আর সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় রূপচর্চায়।
লেখার সূচিপত্র
নিম পাতার উপকারিতা
১. ত্বকের যত্নে
ত্বক ভালো এবং মসৃন রাখতে নিমপাতার জুড়ি মেলা ভার। নিম পাতায় থাকা উপাদান ত্বককে সুস্থ রাখতে সহায়তা করে। নিমপাতায় থাকে ভিটামিন -ই। এটি ত্বক থেকে সকল প্রকার দাগ দূর করতে সাহায্য করে। নিম পাতায় থাকা ফ্যাটি এসিড ত্বকে থাকা তেল চর্বি দূর করে, সকল প্রকার ময়লা দূরীভূত করে।
এক কাপ নিমপাতা বেটে তা মুখে মেখে লাগিয়ে রাখুন ৩০ মিনিট। এরপর ঠান্ডা পানি দিয়ে ত্বক ধুয়ে ফেলুন। এরপর শুকনো তোয়ালে বা টিস্যু দিয়ে মুছে ফেলুন। ব্ল্যাক হোল রিমুভড হয়। এছাড়া, নিমপাতার রস ছেঁকে নিয়ে তা দিয়ে তুলা ভিজিয়ে চোখের উপর দিয়ে রাখুন ১৫ মিনিট। চোখের আশেপাশের দাগ কমবে
২. চুলের জন্য নিম পাতার উপকারিতা
চুলকে মসৃন রাখার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ভিটামিন-ই। এর জন্য অনেকে ভিটামিন-ই ক্যাপসুল খেয়ে থাকেন এটা ই-ক্যাপ ২০০ এবং ই-ক্যাপ ৪০০ নামে পরিচিত। চুলের যত্নে সপ্তাহে কমপক্ষে একবার নিম পাতা ব্যবহার করবেন। এতে চুল পড়া কমবে।
চুলের জন্য নিম পাতার ব্যবহার:
- ২ কাপ পানিতে ১/২কাপ নিমপাতা সেদ্ধ করুন।
- এরপর সেই পানিকে জ্বাল দিয়ে ধীরে ধীরে তা এক কাপ করুন অর্থাৎ পানিটা অর্ধেক করে নিন।
- এরপর সেই পানি চুলে একটু একটু করে পুরো চুলে ব্যবহার করুন। এরপর তা চুলে আধঘন্টা রেখে দিয়ে শ্যাম্পূ করে ফেলুন।
চুল ঝরঝরে দেখাবে। এখানে নিমপাতা কন্ডিশনার এর কাজ করবে।
৩. ব্রণের জন্য নিম পাতার ব্যবহার
ত্বকে ব্রন দেখা দিলে নিমপাতা তা দূর করতে সহায়তা করে। নিমপাতা ব্যাকটেরিয়া, ফাঙ্গাস ও ছত্রাক এর বিরুদ্ধে লড়াই করে। তাই নিমপাতা বেটে নিয়ে তা ব্রন এর জায়গায় লাগিয়ে রাখুন ১৫ মিনিট করে। এরকম করে টানা এক সপ্তাহ এই প্যাক ব্যবাহর করলে ব্রন দূর হয়। আর ব্রনের দাগ সরানোর জন্য ব্যবহার করতে পারেন তুলসী পাতা। কারণ, তুলসী পাতার রস দাগ দূর করে।
ত্বককে উজ্জ্বল রাখার জন্য নিমপাতার সাথে কাঁচা হলুদ বেটে মুখে দিলে অনেক উপকার পাওয়া যায়। এরপর ১/২ চা চামচ হলুদ এর সাথে ১.৫ কাপ নিমপাতা বেটে নিয়ে তা মুখে লাগিয়ে রাখুন ২০ থেকে ৩০ মিনিট। এরপর তা কুসুম গরম পানিতে ধুয়ে ফেলুন। এবং পাতলা কাপড় দিয়ে ত্বক মুছে ফেলুন। তবে নিমপাতা ও হলুদ এর এই প্যাক ব্যবহার করার পর কমপক্ষে দেড় ঘন্টা রোদ এ যাবেন না। এতে ত্বকে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
৪. মুখে নিম পাতার ব্যবহার
নিমপাতা নিয়ে তা কড়া রেদে শুকাতে দিন। এরকম করে ৩ -৪ দিন শুকালে তা ঝরঝরে হয়ে যাবে। এরপর তা ব্লেন্ডার এর সাহায্যে গুঁড়ো করে নিন। একটি কৌটায় ভরে রেখে দিতে পারেন। প্রয়োজন হলে সেখান থেকে সামান্য নিয়ে একটু পানির সাথে মিশিয়ে ঘন প্যাক তৈরি করে মুখে ব্যবহার করতে পারেন।
৫. দাঁত ভালো রাখতে
মুখের জীবানু দূর করার জন্য নিম পাতা উপকারী। ব্যাকটেরিয়ার সাথে নিমের ডাল লড়াই করে। নিমের ডালে থাকা ভেষজ উপাদান দাঁত ভালো, মজবুত এবং সাদা রাখতে দারুন উপকারী। এছাড়া, নিমের ডাল মুখের দুর্গন্ধ দূর করে। নিমের ডাল দিয়ে দাঁত ঘষলে দাঁত ক্যাভিটি থেকে রক্ষা পায়।
৬. কাটা- ছেঁড়া
শরীরের কোনো স্থান যদি কেটে যায় তবে সেখানে নিমের রস ব্যবহার করুন। এতে সে স্থান থেকে জীবানু দূর হবে এবং জ্বালাপোড়া কম হবে।
৭. পুড়ে যাওয়া
কোনো কারনে শরীরের কোনো স্থান পুড়ে গেলে সেখানে নিমপাতা বেটে লাগিয়ে রাখুন। আর জ্বালাপোড়া বেশি হওয়ার কারনে তা সম্ভব না হলে একটা কাপড় নিমের রসে ভিজিয়ে তা ক্ষতস্থানে লাগিয়ে রাখুন। উপকার পাওয়া যাবে।
৮. চুলকানি
শরীরে চুলকানি উপশমের জন্য সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় নিম পাাতা। এমনকি ঔষধের থেকেও বেশি। আমাদের দেশে পক্স এক ধরনের কমন রোগ। এটি গুটিবসন্ত নামেও পরিচিত কিছু জায়গায়। এ সময়ে নিমপাতার ডাল পাতাসহ ভেঙে এতে শরীরে আলতো ভাবে বুলিয়ে দিতে হবে। বেটে লাগানো যাবে না।
৯. মাথার চুলকানি রোধে
নিমপাতার রস ব্যবহার করলে মাথায় চুলকানির সমস্যা কমে যায়। এটি খুশকি প্রতিরোধের জন্যও দারুন একটি পন্থা। মাথায় নিমপাতার রস ঘন করে আধ ঘন্টা বা এক ঘন্টা ভালো করে মেখে রাখলে মাথার চুলকানি সেরে উঠবে। আরেকটি নিম পাতার উপকারিতা হল, এটি উকুনও দূর করে।
১০. লিভারের সমস্যায়
যাদের লিভারে সমস্যা আছে তারা নিমপাতা খেতে পারেন। এতে লিভারের সমস্যা কম হয় এবং আরাম পাওয়া যায়। আপনি চাইলে কাঁচা চিবিয়ে খেতে পারেন। আবার নিমপাতার রস বের করে তা খেতে পারেন। তবে এটি তিতকুটে হয়। ইচ্ছে হলে চিনি যোগ করতে পারেন। ডায়াবেটিস এর সমস্যা থাকলে অবশ্যই চিনি এড়িয়ে চলুন।
১১. রক্তের বিশুদ্ধতায়
রক্ত পরিষ্কার রাখার জন্য নিমপাতা উপকার দেয়। নিমপাতা খেলে রক্তের বিষাক্ত পদার্থগুলো দূর হয়। এতে রক্তের ক্ষতিকর উপাদান দূরে থাকে ফলে, শরীরও রোগমুক্ত থাকে।
১২. আলসার রোধে
নিমে আছে শক্তশালী গ্যাসটো- প্রোটেক্টিভ এসিড। এটি আলসার নিরাময়ের জন্য প্রয়োজনীয় একটি উপাদান। তাই পাকস্থলীতে আলসারের সমস্যা দেখা দিলে তা রোধ করতে নিম পাতা খাওয়া উপকারে আসে।
১৩. ক্যানসারে
নিম পাতায় উপস্থিত ভিটামিন সি, কেরিসেটওন, বিটা ক্যারোটিন, কাইমাফেরল, ডক্সন- বিম্বাইড এর মতে শক্তিশালী উপাদান। আর এই উপাদানগুলো কাজ করে ক্যানসার নিরাময়ে। ক্যানসারের বিরুদ্ধে এই উপাদানগুলো অত্যন্ত কার্যকর। তাই যারা ক্যানসার এর রোগী তারা নিয়মিত নিমপাতা খেতে পারেন।
১৪. রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে
রক্তচাপের রোগীরা সবসময় নিম পাতা খেলে তাদের রক্তচাপের মাত্রা কম থাকে। দৈনিক সকালবেলা এক গ্লাস ( ২৫০ মিলি) পানি ফুটিয়ে ঠান্ডা করে নেবেন। এরপর তা ২০০ মিলি হয়ে গেলে তাতে দুই চা চামচ মধু মিশিয়ে, তসর সাথে নিমপাতার রস মেশাবেন।
দৈনিক খালি পেটে এটা পান করবেন। এতে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকবে কিছুটা। পাথরকুচি পাতার উপকারিতা পড়ে থাকলে জানবেন, পাথরকুচি পাতাও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রন করে।
১৫. হরমোনের সমস্যায়
যারা হরমোনের সমস্যায় ভুগছেন তারাও উপরের নিয়মে পানি ফুটিয়ে নিমপাতার রস মধু সহযোগে খাবেন। তবে হরমোনের সমস্যার জন্য একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখানো প্রয়োজন।
১৬. অ্যাজমা
যাদের অ্যাজমা, হাঁপানি জাতীয় রোগ রয়েছে তাদের জন্য নিমপাতা অনেক উপকারী। নিমগাছ যদি আপনার বাড়ির আশেপাশে থাকে, তাহলে এটা আপনার অ্যাজমার সমস্যাকে কমিয়ে আনবে। কারন, নিমের নির্যাস, উপাদান অ্যাজমা প্রতিরোধে উত্তম।
আর নিমগাছের হাওয়া এই রোগীদের জন্য উপকারী। নিম গাছের ফল ও বীজ থেকে উৎপন্ন তেল ব্যাবহার করলে ভালো পল পাওয়া যায়। তাই, অ্যাজমা রোগীরা বাড়ির পাশে নিমগাছ লাগানোর চেষ্টা করুন।
১৭. ডায়াবেটিস
রক্তে শর্করার পরিমাণ কমাতে নিম উপকারী। এটি শর্করা কমাতে সহায়তা করে।
নিম পাতার অপকারিতা
- ছোট বাচ্চাদের ক্ষেত্রে অতিমাত্রায় নিমের তেল বমি ভাব, দুর্বলতা, মস্তিষ্কের বিভিন্ন রোগের কারণ হতে পারে।
- গর্ভবতী ও নিম্ম রক্তচাপের রোগিদের নিম ব্যবহার না করাই উত্তম।
- অতিমাত্রায় কোন কিছুই ভাল না। নিম পাতা খুব বেশী একসাথে বা ঘন ঘন খাওয়া উচিত নয়।
- খালি পেটে নিয়মিত নিম পাতা খাওয়া উচিত নয়।
- অতি মাত্রায় নিম পাতা কিডনীর ক্ষতি করে।
- অ্যালার্জি যেমন দূর করে নিম পাতা। তেমনি, অতি মাত্রায় নিম পাতা অ্যালার্জির কারণ।
পরিশেষে
সবকিছু ভালো, তবে অতিরিক্ত নয়। তাই নিমপাতা খাবেন তবে পরিমিত। খুব বেশি নয়। আশা করি লেখাটি পড়ে, নিম পাতার উপকারিতা সম্পর্কে সমান্য হলেও ধারণা হয়েছে।