আমাদের বাড়ির আশেপাশে অনেকেই গাছ লাগিয়ে থাকেন। কেউ কেউ নিজের শখের বশে নিজেদের বাড়ির বারান্দায় কিংবা ছাদে গাছ লাগান। মানুষ ঔষধি গাছের দিকে ঝোঁকে বেশি। বিশেষ করে নিম গাছ, তুলসী গাছ, পুদিনা পাতার গাছ এগুলো দেখা যায় সচরাচর। এগুলো মানুষ সব সময় তাদের বারান্দায়, বাড়ির সামনে কিংবা ছাদে লাগিয়ে থাকে। তবে, অনেকেই পুদিনা পাতার উপকারিতা সম্পর্কে জানে না।
বছরের পর বছর ধরে আয়ুর্বেদিক কাজ, সর্দি কাশি নিরাময়ে, বিভিন্ন ঔষধি গুনাগুনের জন্য পুদিনা পাতা ব্যবহার হয়ে আসছে। সাধারণত, সব জায়গায় পুদিনা পাতার গাছ লাগানোর প্রয়োজন পড়ে না। বাসাবাড়ির আশেপাশে এমনিতেই এগুলো নিজে নিজে জন্মে থাকে। এই ছোট পাতার গুনাগুন অনেক। নিচে এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
পুদিনা পাতার চা আমাদের দেশে বেশ জনপ্রিয়। যারা চা খেতে পছন্দ করেন, শরীর ঠান্ডা রাখার জন্য তারা পুদিনা পাতা দিয়ে চা খেয়ে থাকেন। স্বাস্থ্য ভালো রাখতে পুদিনা পাতার ব্যবহার ব্যাপক। ঔষধ তৈরিতে ব্যবহৃত হয় পুদিনা পাতা। আবার, শরীর ঠান্ডা রাখতেও পুদিনা পাতার উপকারিতা অনেক।
লেখার সূচিপত্র
পুদিনা পাতার উপকারিতা
পুদিনা পাতার বৈশিষ্ট্য
- পুদিনা গাছ খুব ছোট আকারের হয়ে থাকে।
- পাতা ও কান্ড অনেক নরম।
- পাতা সবুজ রঙের ও ডিম্বাকার হয়।
- পাতার কিনারাগুলো খাঁজকাটা হয়ে থাকে।
- পাতা লোমশ, গন্ধটা তীব্র মিষ্ট।
- গাছের উচ্চতা ৫০ থেকে ৯০ সেন্টিমিটার হয়ে থাকে।
- গাছ দ্রুত বৃদ্ধি পায় ও যখন বড় হতে থাকে তখন ঝোপ তৈরি করে।
১. নিঃশাস সতেজ রাখতে
আমরা দৈনিক সকালে উঠে মিসওয়াক বা দাঁত ব্রাশ করি। আর একটু লক্ষ করলে দেখতে পাই, টুথপেষ্টে লবন, লবঙ্গ, পুদিনা পাতা ব্যবহার করা হয়। এখানে পুদিনা পাতা ব্যবহারের কারনেই আমরা মুখে ঠান্ডা অনুভব করি। এক ধরনের সুন্দর যে ঘ্রানটা অনুব করি, তাও পুদিনা পাতার কারনেই। এটা নিঃশাস সতেজে সহায়তা করে।
২. দাঁতের যত্নে
টুথপেষ্টে পুদিনা পাতার ব্যবহার এর কারনে দাঁত ভলো থাকে। পুদিনা পাতায় আছে অ্যান্টি- ব্যাকটেরিয়াল বৈশিষ্ট্য। এ কারনে দাঁতের জীবানু ধ্বংস হয়। আর দাঁত মজবুত করে। দাঁতের যত্ন ও সুগন্ধ উভয় দিকের কথা লক্ষ করে বিভিন্ন মাউথওয়াশ এমনকি চুইংগামেও পুদিনা পাতা ব্যবহার করা হয়।
৩. ক্লান্তি দূরীকরনে
অনেক সময় যখন আমাদের শরীর ক্লান্ত হয়ে যায়, তখন আমরা পুদিনা পাতা খেতে পারি। এতে থাকা প্রাকৃতিক উপাদান শরীর ঠান্ডা করে, সতেজ রাখে। দুইটি পুদিনা পাতা নিয়ে চিবিয়ে খেতে পারেন। শরবত তৈরি করে, তাতে পুদিনা পাতা কুঁচি করে কেটে বা আস্ত দিয়ে সেই শরবত খেতে পারেন। রিল্যাক্স ফিল করবেন। এটা সবচেয়ে বড় পুদিনা পাতার উপকারিতা।
৪. সাইনাসের সমস্যায়
পুদিনা পাতায় আছে অ্যান্টি- ইনফ্লেমটরি, অ্যান্টি ভাইরাল, অ্যান্টি ব্যাকরটেরিয়াল উপাদান। এসকল উপাদান শরীরের৷ জমে থাকা অ্যালার্জিজনিত রোগ দূরীকরণ করতে সহায়ক।পুদিনা পাতা দিয়ে আপনি চা তৈরি করে কেতে পারেন।
- ১.৫ কাপ পানিতে ৩ টি পুদিনা পাতা দিয়ে তা ফুটিয়ে ১ কাপ করে আনুন।
- এরপর সেই চা একটু চিনি বা মধু সহকারে পান করুন।
এতে ঠান্ডা জনিত সমস্যার উপশম হয়। আবার সাইনাসের সমস্যাকে দূরে ঠেলে দেয়। তবে কাশির ক্ষেত্রে তুলসী পাতার চা ব্যবহার করুন।
৫. হজম সমস্যায়
অনেক সময় বেশি খাওয়া হয়ে যায়। কারো বা থাকে এমনিতেই হজমের সমস্যা। এ সময়ে পুদিনা পাতা কাজে দেয়। পুদিনা পাতা চিবিয়ে কিংবা এর চা খান। হজমের সমস্যা দেখা দেবে না।
৬. পেট ব্যাথায় ও গ্যাস্ট্রিকে
অনেল সময় হঠাৎ করেই পেট ব্যথা দেখা যায়, কখনোবা হয় গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা। দেখা গেল, এমন সময় বাসায় ঔষধ- ও থাকে না। তখন গরম পানিতে পুদিনা পাতা ফুটিয়ে তা পান করুন। এতে পেটের ব্যাথার উপশম হবে। কারন পুদিনা পাচনতন্ত্র কে শিথিল করতে সাহায্য করে এবং ব্যাথা কমায়। এর কারনে মসৃন পেশিগুলো সংকুচিত হতে পারে না। তাই ব্যাথার উপশম হয়।
৭. চিন্তা দূর করে
অনেকেই টেনশনে ভোগেন। ফলে মাথা ভার হয়ে থাকে। অসহ্য যন্ত্রণা হয়। টেনশন চাইলেও দূর করতে পারেন না। তবে মাথা ভার কমানো দূর করতে পারেন।পুদিনা পাতা বেটে ( ১ চা চামচ) মাথায় পাতলা আস্তরন দিন। এতে ধীরে ধীরে মাথার যন্ত্রণা কমবে। পুদিনা পাতার চা খেলেও মাথা যন্ত্রনা কমে।
৮. মাইগ্রেনের সমস্যায়
মাইগ্রেনের সমস্যা মানেই মাথা ব্যথা। মাথা ব্যথা অনেক সময় গলাসহ সারা মাথায় ছড়িয়ে পড়ে। যা, অত্যন্ত বিরক্তিকর। এসময় পুদিনা পাতার তেল এর মতো উপকার আর কিছুতে পাওয়া যায়না। পেপার মিন্ট অয়েল নামে পুদিনা পাতার তেল কিনতে পাওয়া যায়। এটি ব্যবহার করলে মাথা ব্যথা দ্রুত কমে।
সম্প্রতি একটি গবেষণায় দেখ গেছে, পুদিনা পাতার তেল মাথায় এবং গলায় মালিশ করলে ১ ঘন্টার মধ্যে ব্যথা পুরোপুরি কমে যাবে। এটা ট্রাই করে দেখতে পারেন।
৯. স্মৃতিশক্তি বাড়াতে
বিজ্ঞানীরা মনে করেন পুদিনা পাতা খেলে মানুষের স্মৃতিশক্তির পরিমান বেড়ে যায়। এতে থাকা প্রাকৃতিক উপাদানসমূহ মানুষকে শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রশান্তি দেয়। ফলে মানুষ প্রফুল্ল থাকে। এই কারনে কোনো কিছু মানুষ সহজে মনে রাখতে পারে। এতে বুদ্ধি বাড়ে, স্মৃতিশক্তি বাড়ে। সাইলোলজিস্ট দের মতে নিয়মিত পুদিনা পাতা খেলে মানুষের মস্তিষ্ক সতর্ক হওয়ার হার বাড়িয়ে দেয়।
১০. ব্রন দূর করতে
পুদিনা পাতায় উপস্থিত শক্তিশালী স্যালিসাইলিক এসিড। এই এসিড সহজেই মানুষের ত্বকের ব্রন দূর করতে সক্ষম।
- ১ কাপ পুদিনা পাতা বেটে ব্রন এর জায়গায় লাগিয়ে রাখুন।
- এরপর ঠান্ডা পানি দিয়ে ধুয়ে নিন।
- এরকম প্রায় এক সপ্তাহ চালিয়ে গেলে ব্রন চলে যাবে।
এর আগে যারা আমাদের পূর্বের লেখা, নিম পাতার উপকারিতা পড়েছেন। তারা জানেন নিম পাতাও ব্রন দূর করে।
১১. দাগ দূর করতে
পুদিনা পাতায় আছে মেন্থল। আপনার শরীরে কোথাও সূর্যের তাপ কালো দাগ দেখা দিলে বা ব্রনের দাগ দূর করতে পুদিনা পাতার রস ব্যবহার করতে পারেন।
১২. শরীর সতেজ রাখতে
সারাদিন স্কুল/ কলেজ/ অফিস শেষে বাড়ি ফিরে এসে কার না ক্লান্তি লাগে? এছাড়া এখন সূর্যের তাপ বেশি। গরমও পড়েছে প্রচুর।
- তাই দিনশেষে শরীর ঠান্ডা করতে এক বালতি পানিতে ১১ থেকে ১৫ টি পুদিনা পাতা রেখে দিন ১০ মিনিট।
- চাইলে লেবু রাউন্ড শেইপে কেটে তাও যোগ করতে পারেন।
- এরপর সেই পানিতে গোসল করুন।
পুদিনা পাতায় থাকা মেন্থল শরীরকে ঠান্ডা করবে। আর পুদিনা পাতায় মেন্থল থাকার কারনে কিছু সাবান তৈরিতেও এটি ব্যবহৃত হয়।
১৩. বুকে কফ জমে গেলে
অনেক সময় কাশতে কাশতে এমন এক পর্যায় আসে যখন বুকে অনেক কফ জমে যায়। এসময় মূলত ফুসফুসে মিউকাস আটকে থাকে। তাই পুদিনা পাতার রস খেলে এসময় বুকের কফ নেমে যায়। ফলে আরাম পাওয়া যায়। এর কারন এতে উপস্থিত থাকা মেন্থল।
১৪. শ্বাসকষ্টের সমস্যায়
অনেকের শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে বিভিন্ন ধরনের ঔষধ খেয়ে থাকেন। তবে হাতের কাছে ঔষধ না থাকলে পুদিনা পাতা খেতে পারেন। এতে শ্বাসকষ্ট কমবে কিছুটা।
১৫. নাকের সমস্যায়
নাকের ফুলে ওঠা মেমব্রেনকে সারাতে গাছ গাছালির মধ্যে সবচেয়ে উপকারী হলো পুদিনা পাতা। কারন এর মেন্থল নাককে ধীরে ধীরে শান্ত করে তোলে। তবে অতিরিক্ত পুদিনা গ্রহন শ্বাসনালিতে সমস্যা হয়।
১৬. ওজন কমানোয়
অনেকের ওজন বেশি। ফলে এই নিয়ে তারা অনেক ভেগান্তিতে পড়েন। এসময় পুদিনা পাতা থেকে তৈরি ‘ এসেন্সিয়াল অয়েল’ ইউজ করতে পারেন। এটি বর্জ্য অপসারন করতে সহায়ক। ফলে পুষ্টি সহজেই খাবার থেকে পাওয়া যায়। এবং এতে ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকে।
১৭. কাশির জন্য
বেশি কাশি হলে ১ টেবিল চামচ তুলসী পাতার সাথে ১ চা চামচ মধু যোগ করে খাওয়ানো হলে কাশি সেরে যাবে।
১৮. অন্যান্য
করোনার মধ্যে আমরা সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করেছি হ্যান্ড স্যানিটাইজার। এগুলো ব্যবহার করার ফলে হাত জীবানু মুক্ত হয়, পাশাপাশি ঠান্ডা অনুভূত হয়। এর কারন এতে পুদিনা পাতা ব্যবহৃত হয় কিছু ক্ষেত্রে। বিভিন্ন ধরনের ঔষধ তৈরিতে পুদিনা পাতার ব্যবহার লক্ষ করা যায়।
পুদিনা পাতার অপকারিতা
- অনেকের ক্ষেত্রে পুদিনা পাতা উপকারিতা এর বদলে অপকার করে। পুদিনা পাতা অনেক সময় অ্যালার্জির কারণ হয়।
- পুদিনা পাতা রক্তে শর্করা কমিয়ে দিতে পারে। ফলে ডায়েবেটিকস রোগিদের জন্য এটা ক্ষতিকর হতে পারে।
- শিশুদের জন্য পুদিনা পাতা ক্ষতিকর।
- অনেক ওষুদের সাথে পুদিনা পাতা বিক্রিয়া করে। ফলে, শরীরের ক্ষতি সাধন করতে পারে।
পরিশেষে
পুদিনা পাতা যেকোনো কিছুতে ব্যবহার করা যায়। চা, শরবত, রান্না থেকে রূপচর্চা, আয়ুর্বেদ সব জায়গায় এর ব্যবহার। তবে অতিরিক্ত ব্যবহার করা অবশ্যই ক্ষতিকর। আশা করি আপনাদের কাছে আজকের এই লেখাটি ভালো লাগবে এবং পুদিনা পাতার উপকারিতাগুলো নিজের জীবনে কাজে লাগাতে পারবেন।